রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজপরিবারের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে রাণী ভিক্টোরিয়া স্বয়ং ঘোড়ার গাড়ি পাঠিয়েছিলেন প্রিন্সের শেষকৃত্যের জন্য।কিন্তু দ্বারকানাথ যখন ভারতে রেলপথ বসিয়ে যাত্রীদের এক নতুন পরিষেবা দিতে উদ্যোগী হন, তখন তাঁর সেই ইচ্ছা বাধাপ্রাপ্ত হয় তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা। কেন এবং কোন অজানা কারণে এমনটা ঘটেছিল, তা আজও অজানা। দ্বারকানাথের মৃত্যুর বহু বছর পরে আমাদের এই বাংলাতেই কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানায় এক রেলপথের সূচনা হয় ১৮৯৪ সালে। এই রেলপথের পোশাকি নাম ছিল বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেলওয়ে (বিপিআর) অর্থাৎ বেঙ্গল প্রাদেশিক রেলওয়ে।
১৮৯৪ সালে যাত্রা শুরু করলেও বিপিয়ার সংস্থার নাম সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয় ১৮৯০সালে। নাম যা-ই হোক না কেন, সাধারণ যাত্রীদের কাছে এই রেলপথ পরিচিত ছিল তারকেশ্বর-মগরা রেলওয়ে হিসেবে। বাঙালি উদ্যোগপতি অন্নদাপ্রসাদ রায় ছিলেন মূলত এই রেলপথের মালিক। প্রথমে এই রেলপথটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩২ মাইল। পরে আরও দু মাইল বাড়ে ত্রিবেণী স্টেশনটির সংযুক্তিকরণের ফলে। এই রুটের জংশন স্টেশনটি ছিল দশঘড়া। হাওড়া বর্ধমান মেইন এবং হাওড়া বর্ধমান কর্ডলাইনের বিভিন্ন স্টেশনের মধ্যে দিয়ে স্থানীয় স্বার্থে নির্মিত ব্যক্তিগত মালিকানার এই ট্রেন চলত তারকেশ্বর, গোপীনাথপুর, রুদ্রানী, মাজিনান, সুলতানগাছা, নিশ্চিতখোলা, চকদীঘি, শ্রীকৃষ্ণপুর দিয়ে।
দুঃখের বিষয় হল ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর পর থেকেই এই রেলপথ এবং এই রেলবাণিজ্যটি লাভের বদলে লোকসানের মুখ দেখতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিল বেশিরভাগ সময়ই যাত্রীদের বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ার প্রবণতা, এহেন অভ্যাস আজও ভারতীয় রেলযাত্রীদের মধ্যে রয়ে গেছে। ১৯২৬ সালে ভারতীয় রেলের আইন অনুসারে বিপিআর রেলপথটিকে তৃতীয় শ্রেণীর রেল হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেল পরিষেবায় ব্যবহার করা হত তিনটি লোকমোটিভ, একত্রিশটি কোচ আর ৬৯টি পণ্যবাহী ওয়াগান।
সবরকম চেষ্টা করেও শেষরক্ষা করা যায়নি। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে ব্রিটিশ ভারতে স্থাপন করা ব্যক্তিগত মালিকানার একটি রেলপথ স্বাধীন ভারতে পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দিতে হয় ১৯৫৬ সালে। আজও রুদ্রানীর পথ-ঘাট, কালভার্ট বিপিয়ার রেলের অতীত স্মৃতি বহন করছে। এই রুটের কয়েকটি স্টেশন বর্তমানে ব্যক্তিগত বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক সময় বেঙ্গল প্রভিনশিয়াল রেলওয়ের শেয়ার কিনেছিলেন বহু সম্পন্ন ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কলকাতা বাবু গোষ্ঠীর এবং রাজা উপাধিধারী কিছু মানুষও।
কিছু শেয়ার কিনেছিলেন হুগলিরই বাসিন্দা রাজা পিয়ারী মোহন। সেই শেয়ার-এর অর্থমূল্য ছিল ৮ লক্ষ টাকা। বিপিআর -এর শেষ পর্যায়ে তিনি এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা জানা নেই। তবে রাজা পিয়ারীর সাক্ষর করা কিছু নথি আবিষ্কার করা গেছে সম্প্রতি। আজ বিপিআর -এর ন্যারোগেজ লাইন আজ লুপ্ত হয়ে গেছে চিরতরে, যদিও তার কিছু বিচ্ছিন্ন তথ্য লুকোনো রয়েছে ইতিহাসের অবিন্যস্ত পাতায়।